আব্বা মারা যাওয়ার মাস তিনেক পরে কী একটা দরকারে একটা সরকারি ফরম পূরণ করছিলাম। ‘পিতার নামঃ’ এর পাশে আব্বার নাম লিখলাম। এক বন্ধু বলল, ‘চাচার নামের আগে, “মৃত” কথাটা লিখতে হবে।’ আমি জানি আব্বা মারা গেছে। তারপরও তাঁর নামের পাশে নিজের হাতে ‘মৃত’ কথাটি লিখতে হবে! ধাক্কা খেলাম। বিরাট ধাক্কা। তারপর এই এত দিনে অনেকবার তাঁর নামের আগে ‘মৃত’ কথাটি লিখতে হয়েছে। ধীরে ধীরে ধাক্কা সয়ে গেছে। এখন তাঁর নামের পাশে ‘মৃত’ কথাটি সহজে লিখতে পারি। অসুবিধা হয় না।
আমার প্রথম সন্তান মোজাদ্দেদ আলফেসানি সোয়াতকে যখন চিকিৎসকেরা শেষ পর্যন্ত ‘অটিস্টিক রোগী’ (আধুনিক ভদ্রলোকের ভাষায় ‘বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন রোগী’ এবং গরিবগুর্বার সোজা বাংলায় ‘বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী’) হিসেবে রায় দিয়ে দিলেন, তখন একই ধরনের ধাক্কা খেয়েছিলাম। তার বয়স এক বছর হওয়ার পরও যখন কথা বলছিল না, রেসপন্স করছিল না, চোখে চোখ রেখে (আই কন্টাক্ট) অভিব্যক্তি প্রকাশ করছিল না, তখনই আমার ও আমার স্ত্রীর সন্দেহ হচ্ছিল। পরে আমাদের সন্দেহ সত্য হয়েছিল।
এরপরে আমাদের আরেকটি ছেলে হয়। অতি অদ্ভুতভাবে সেও একজন অটিস্টিক শিশু। তার নাম সাঈদ আল সাহাফ। এখন সোয়াতের দৈহিক বয়স ১২ বছর হলেও তার বুদ্ধিবৃত্তিক বয়স ৩ বছরেরও কম। অর্থাৎ গায়ে গতরে তাকে যতই সাবালক দেখাক, আদতে সে জ্ঞানবুদ্ধিতে ৩ বছরেরও কম বয়সী শিশু। সাহাফের দৈহিক বয়স ৯ বছর। তবে তার জ্ঞান বুদ্ধি সোয়াতের চেয়ে একটু ভালো। তার বুদ্ধিবৃত্তিক বয়স চার বছর।
সোয়াত ও সাহাফের প্রতিবন্ধিতার সরকারি কার্ড (প্রতিবন্ধিতার পরিচয়পত্র) আছে। এই কার্ড নিশ্চিত করে সাক্ষ্য দেয় তারা প্রতিবন্ধী। এই কার্ড দুটি যখন দেখি তখন নিজের প্রয়াত পিতার নামের পাশে ‘মৃত’ কথাটি লিখতে গিয়ে ধাক্কা খাওয়ার মতো প্রতিবারই ধাক্কা খাই। কারণ আমার (এবং অবশ্যই সোয়াত-সাহাফের মায়েরও) যুক্তিনির্ভর জ্ঞানবুদ্ধি যতই বলুক ‘সত্যরে লও সহজে’; কিন্তু অন্তস্থ আবেগনির্ভর যুক্তিবিরোধী পিতৃসত্ত্বা বলে ‘মানি না’।
মানতে না পারার কারণ আমি চিন্তা করে বের করার চেষ্টা করেছি। একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নিজেই দাঁড় করিয়েছি। ব্যাখ্যাটা এ রকম: আসলে আমরা এই দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বভাবতই উদ্বিগ্ন। আমাদের দুজনের বা যে কোনো একজনের মৃত্যু হলে এই মুহূর্তে তাদের কে দেখাশোনা করবে? এই উদ্বেগ আমাদের তাড়িত করে।
দ্বিতীয় চিন্তাটি হলো, এখন তারা শিশু। বছর কয়েক বাদে তারা যদিওবা শারীরিকভাবে বয়স্ক হয়ে উঠবে, কিন্তু মানসিকভাবে শিশুই থেকে যাবে। তারা প্রাপ্তবয়স্ক হবে, প্রাপ্তমনস্ক হবে না। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কোনো নারী-পুরুষ কাউকে জড়িয়ে ধরলে তিনি এখন তাদের অবুঝ আচরণ যতটা স্নেহের চোখে দেখেন, দৈহিকভাবে বড় হয়ে ওঠার পর তখন ততটা দেখবেন না। ছেলেধরা সন্দেহে বহু অটিস্টিক ব্যক্তিকে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা আমাদের তা স্মরণ করিয়ে দেয়।
আমার এই দুই পুত্র উপার্জন করতে পারবে না, তাদের দেখভালের দায় কেউ নেবেও না। তখন তারা কীভাবে জীবন কাটাবে, সেই চিন্তা পিতা-মাতা হিসেবে আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। সে কারণে যখনই আমাদের মনে পড়ে তারা প্রতিবন্ধী, তারা অটিস্টিক, তখনই সেই অনিশ্চয়তার বোধ আমাদের ঘুমন্ত উদ্বেগকে প্রবলভাবে জাগিয়ে তোলে। সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আতঙ্ক আমাদের শিহরিত করে। এ কারণে যতবার তাদের প্রতিবন্ধী কার্ড দেখি, ততবার ধাক্কা খাই।
আমি জানি আমার এবং আমার স্ত্রীর মতো লাখো অটিস্টিক সন্তানের বাবা-মা একই আতঙ্কে দিন কাটান। কিন্তু রাষ্ট্র চাইলে সেই আতঙ্কের একটি বিরাট অংশ দূর করতে পারে।
আমাদের দেশে সরকার প্রতিবন্ধীদের জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তার পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় আনুবিক্ষণীক। অটিস্টিকসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রতি মাসে প্রতিবন্ধী ভাতা হিসেবে সরকার যে অর্থ দিয়ে থাকে তা দিয়ে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির তিন দিনের খাবারের খরচও হবে না। অথচ প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা অপচয়, লোপাট ও পাচারের খবর সংবাদপত্রে আসছে। শুধু লুট হওয়া টাকার একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ যদি অটিস্টিক রোগীদের সার্বিক দেখভালের জন্য বরাদ্দ করা হতো তাহলে নিশ্চিতভাবে আমার মতো লাখো পিতা-মাতাকে প্রতিবন্ধী সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আতঙ্কে দিন পার করতে হতো না।
প্রতি বছর বিশ্ব অটিজম দিবসে নতুন নতুন প্রতিপাদ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়, তার মধ্যে বিরাট এক শুভংকরের ফাঁকি থেকে যায়। সাধারণত এসব কার্যক্রমে অটিস্টিক শিশুদের সামনে রাখা হয়। অটিস্টিক সন্তানদের মা–বাবাকে উদ্দীপনামূলক অনেক ভালো ভালো, মিষ্টি মিষ্টি কথা শোনানো হয়। অনুষ্ঠান করা হয়। অটিস্টিক শিশুদের এনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান টাইপের কিছু কার্যক্রম চলে। সেগুলো সুন্দর করে ভিডিও করা হয়। ছবি তোলা হয়। শিশুদের খাওয়া–দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তারপর সে সব ভিডিওচিত্র ও আলোকচিত্র সম্প্রচার করা হয়। কাগজে ছাপা হয়। সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও সংগঠনের কৃতিত্ব ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। অধিদপ্তর ও সংগঠনের জন্য তখন দেশি-বিদেশি তহবিল থেকে নতুন নতুন বরাদ্দ আসে।
অর্থাৎ দিন শেষে যা দাঁড়ায়, তা হলো এই অটিস্টিক শিশুদের সামনে রেখে খুবই স্থূলভাবে ব্যবসা চলছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এই ঢাকা শহরে একটু ভালোমানের যতগুলো বেসরকারি অটিস্টিকদের স্কুল রয়েছে সেখানে একজন অটিস্টিক বাচ্চার ভর্তি ফি ও মাসিক ফি বাবদ যে অর্থ নেওয়া হয় তা জোগানো দরিদ্র মানুষ তো দূরের কথা অনেক উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষেও সম্ভব না। মাসে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকারও বেশি অর্থ মাসিক ফি হিসেবে নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজেদের ‘অলাভজনক প্রতিষ্ঠান’ ঘোষণা করে এবং ‘অটিস্টিক শিশুদের জন্য সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছি’—ধরনের বিশ্বহিতৈষী ভাব নিয়ে সমানে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এসব প্রচারণা দিয়ে সরাসরি তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করে যাচ্ছে। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে এসব অবুঝ রোগীদের এনে যে যার আখের গুছিয়ে যাচ্ছে। অটিস্টিক শিশুদের মা–বাবা হিসেবে এই অবস্থা আমাদের মেনে নিতে কষ্ট হয়।
উন্নত বিশ্বে অটিস্টিক রোগীদের দায়িত্ব নিয়ে থাকে রাষ্ট্র। তাদের শৈশব থেকে মৃত্যু অবধি রাষ্ট্র সব ধরনের দায়–দায়িত্ব নিয়ে থাকে। তাদের খাওয়া-দাওয়া চিকিৎসা এবং বেড়ে ওঠার যাবতীয় দেখভাল করে থাকে রাষ্ট্র। গণপরিবহনে তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকে। যেকোনো পাবলিক পরিসরে তাদের উপযোগী করে বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়। সেখানে তাঁরা একজন অটিস্টিক ব্যক্তিকে রোগী বলে না। তারা তাদের আগে বলত, ‘ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড’। তারপর সেখান থেকে সরে এসে এখন বলে, ‘ডিফারেন্টলি এনাবল্ড’। অর্থাৎ এই রোগীরাও সক্ষম। কিন্তু তাদের সেই সক্ষমতার প্রকাশ হয় ভিন্নভাবে। তারা শুধু বলার মধ্যে আটকে থাকেনি। তারা এই মানুষগুলোর জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে এমন একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেছে যে, সেখানকার মা–বাবাকে আমাদের মতো সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় সারাক্ষণ আতঙ্কে কাটাতে হয় না।
বাংলাদেশের এখন যে আর্থিক সক্ষমতা হয়েছে, তা দিয়ে অটিস্টিক ব্যক্তিদের আজীবন দেখভালের সরকারি ব্যবস্থা করা সম্ভব। আমরা বিশাল বিশাল মেগা প্রজেক্ট করার ক্ষমতা রাখছি। হাজার কোটি টাকার প্রকল্প এখন আমাদের কাছে জলভাত। ফলে এর জন্য যে অর্থের দরকার তা আমাদের আছে। খুব ভালোভাবেই আছে। যা নেই তা হলো, মাইন্ডসেট বা মানসিকতা।
আজ (২ এপ্রিল) বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। আমরা যারা বাংলাদেশের অটিস্টিক সন্তানদের মা–বাবা, তাদের কাছে এটি ধাক্কা খাওয়ার দিন। এটি আমাদের কাছে সমাজ ও রাষ্ট্রের মানসিকতা বদলে দেওয়ার জন্য ধাক্কা দেওয়ারও দিন। আমরা ধাক্কা দিতে দিতে রাষ্ট্রের মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য অধীর প্রতীক্ষায় আছি। আমরা সেই দিনের প্রতীক্ষায় আছি যেদিন প্রতিবন্ধী সন্তানের প্রতিবন্ধী পরিচয়পত্র দেখে আর আমাদের ধাক্কা খেতে হবে না।
Leave a Reply