শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গারে দুই বিমানের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজের লেজের হরিজেন্টাল স্ট্যাবিলাইজার ভেঙে গেছে। অপর বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজের ককপিটের একটি অংশ ছিদ্র ও নোজের বড় অংশ গেছে (বিমানের নাক) দুমড়ে-মুচড়ে।
দুটি উড়োজাহাজই বিমানবহরে নতুন। ড্যাশ-৮ কিউ ৪০০-এর অনভিজ্ঞ টোম্যানকে দিয়ে হ্যাঙ্গার থেকে বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ বের করতে গিয়ে রোববার (১০ এপ্রিল) সন্ধ্যায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে বিমানের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামাল বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, কেন, কীভাবে এ দুর্ঘটনা ঘটল, তা বের করতে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটি প্রতিবেদন দিলে কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে।
এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বেসামরিক বিমান পরিবহণ প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। এটি নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা-তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
জানা যায়, রোববার (১০ এপ্রিল) সন্ধ্যায় টোম্যান বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজটি হ্যাঙ্গার থেকে বের করার জন্য পুশ বোতামে চাপ দেওয়ার পরই এটি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ফলে বোয়িং ৭৩৭ সজোরে ধাক্কা দেয় হ্যাঙ্গারে থাকা বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজের লেজে (টেল)।
এতে একটি উড়োজাহাজের লেজ ও পাখার কিছু অংশ ভেঙে গেছে। অপরটির ককপিটের একটি অংশ ছিদ্র হয়ে দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, টোম্যানের অনভিজ্ঞতার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
ঘটনাটি বিমানের পুরো ম্যানেজমেন্টের ব্যর্থতা বলেও তারা মনে করেন। তারা বলেন, একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও কারও কোনো ধরনের জবাবদিহি নেই। ফলে যে যেভাবে পারছে অনৈতিক কাজ করে যাচ্ছে।
দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত উড়োজাহাজ দুটি গ্রাউন্ডেড ঘোষণা করা হয়েছে। খবর দেওয়া হয়েছে উড়োজাহাজ নির্মাতা কোম্পানি বোয়িংকে। তারা আসার পর এগুলো মেরামতের জন্য শপে পাঠানো হবে। ধারণা করা হচ্ছে-এ ঘটনায় কমপক্ষে অর্ধশত কোটি টাকার বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ বিমান।
একই সঙ্গে এক মাসের বেশি সময় মেরামতের জন্য উড়োজাহাজ দুটিকে হ্যাঙ্গারে থাকতে হবে। তাতে ফ্লাইট চালাতে না পারায় বিপুল অঙ্কের টাকা লোকসান হবে বিমানের।
খবর পেয়ে সোমবার বিমান দুটি দেখতে হ্যাঙ্গারে ছুটে গেছেন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী। তিনি এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে অবিলম্বে এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।
একই সঙ্গে এর আগে যাত্রী ক্যাবিনে ভারী কার্গো পণ্য বহন করে বিমানের ৮টি উড়োজাহাজের কী কী ক্ষতি হয়েছে, তারও তালিকা প্রস্তুতের নির্দেশ দেন। কারা এই কার্গো পণ্য পরিবহণের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের নামের তালিকা দেওয়ার কথাও বলেন।
তিনি যুগান্তরকে বলেন, এর আগে বিমানের অপর একটি উড়োজাহাজ বার্ড হিট হয়ে গ্রাউন্ডেড হয়েছে। এটি বিমানের অত্যাধুনিক উড়োজাহাজ ড্রিমলাইনার। প্রসঙ্গত, বর্তমানে সব মিলে বিমানের চারটি উড়োজাহাজ গ্রাউন্ডেড হয়ে আছে। এ অবস্থায় বিমানের ফ্লাইট শিডিউল লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছে। ২-৩ ঘণ্টা দেরিতে বিমান ছাড়ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হ্যাঙ্গারের এক কর্মী যুগান্তরকে বলেন, সাধারণত হ্যাঙ্গারে থাকা উড়োজাহাজগুলো পাইলট দিয়ে পরিচালনা করা হয় না। তখন উড়োজাহাজের সব ধরনের ইঞ্জিন ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রের সুইচ বন্ধ থাকে।
এ অবস্থায় অভিজ্ঞ কর্মীর মাধ্যমে বাইরে থেকে বিভিন্ন মেশিনের মাধ্যমে উড়োজাহাজ পরিচালনা করা হয়। প্রতিটি উড়োজাহাজের জন্য আলাদা আলাদা অভিজ্ঞ কর্মী কাজ করে থাকেন হ্যাঙ্গারে। কিন্তু এক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটেছে।
বিমানের প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম গোপন রেখে যুগান্তরকে বলেন, অবহেলার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে। কারণ, বিমানের ড্যাশ-৮ কিউ ৪০০ উড়োজাহাজের টোম্যানকে দিয়ে হ্যাঙ্গার থেকে এই বিমান বের করার কথা নয়।
ড্যাশ-৮ কিউ ৪০০ উড়োজাহাজ বিমানবহরের সবচেয়ে ছোট উড়োজাহাজ। এর দ্বিগুণের চেয়ে বড় বোয়িং ৭৩৭। অনভিজ্ঞ কারও পক্ষে এত বড় উড়োজাহাজ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া হ্যাঙ্গারে বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজের জন্য আলাদা ও দক্ষ একাধিক টোম্যান আছেন।
কিন্তু কী কারণে তাদেরকে না জানিয়ে ড্যাশ-৮-এর টোম্যান দিয়ে ৭৩৭ উড়োজাহাজ বের করা হলো, সেটি রহস্যজনক। কাজটি করানোর আগে দুর্ঘটনার কোনো বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এক ধরনের জোর করে ড্যাশ-৮ কিউ ৪০০-এর টোম্যানকে দিয়েই বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ বের করার চেষ্টা চালানো হয়। এতেই ঘটে এ দুর্ঘটনা।
বিমান সূত্রে জানা যায়, সব মিলিয়ে বর্তমানে বিমানবহরে ২১টি উড়োজাহাজ রয়েছে। রোববারের দুর্ঘটনার ৩ সপ্তাহ আগে একটি বোয়িং ড্রিমলাইনারে বার্ড হিট হয়। সেটিও গ্রাউন্ডেড। সব মিলিয়ে বর্তমানে চারটি উড়োজাহাজ গ্রাউন্ডেড হয়ে পড়ে আছে হ্যাঙ্গারে।
এর মধ্যে একটি ড্যাশ, একটি ড্রিমলাইনার, একটি বোয়িং ৭৩৭ এবং একটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর। এ অবস্থায় বিমানের ফ্লাইট শিডিউল লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছে। রোববার (১০ এপ্রিল) রাত থেকে বিমানের প্রতিটি ফ্লাইট গড়ে ২-৩ ঘণ্টা করে বিলম্বে ছেড়েছে।
সোমবার (১১ এপ্রিল) অধিকাংশ ফ্লাইটও বিলম্বে ছেড়েছে। সংঘর্ষের কারণে রোববার রাতের বিমানের দুবাই ফ্লাইট বাতিল করা হয়। এরপর যাত্রীদের সোমবার (১১ এপ্রিল) সকালে নতুন ফ্লাইটে দুবাই পাঠানো হয়েছে। যার কারণে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন শত শত বিমানযাত্রী।
অভিযোগ আছে, এর আগেও বিমানের অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে মাত্র কয়েক কোটি টাকা মুনাফা করতে গিয়ে হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বিমানবহরে আসা নতুন আটটি উড়োজাহাজের।
যাত্রী ক্যাবিনে ভারী কার্গো বহন করে চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর, দুটি বি-৭৩৭ এবং ভাড়ায় আনা দুটি এয়ারক্রাফটের শতাধিক সিটের (আসন) হাতল দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। পুরোপুরি এবং আংশিক ভেঙে গেছে অর্ধশতাধিক সিট।
বিকল এবং যান্ত্রিক ত্রুটির সৃষ্টি হয়েছে ৭০টির বেশি মুভি সেটের। এছাড়া নষ্ট হয়েছে ইন্টেরিয়র ডেকোরেটর, টয়লেট, ফ্লোর, দেওয়াল, খাবার রাখার গ্যালিসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র। কাদা, রং আর কেমিক্যাল লেগে একাকার হয়ে গেছে সব উড়োজাহাজের সিটের কাপড়, ভেতরের দেওয়াল এবং দেওয়ালে আঁকা নান্দনিক চিত্রকর্মের।
ভাড়ায় আনা উড়োজাহাজগুলোর এতটাই ক্ষতি হয়েছে যে, সেগুলোকে শেষ পর্যন্ত মোটা অঙ্কের টাকায় কিনে নিতে হয়েছে বিমানকে। অথচ এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও কারও বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ পর্যন্ত জারি করা হয়নি। জানা যায়, এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। এরপর বিমানের পক্ষ থেকে জানানো হয়-বিভিন্ন দেশ থেকে ভ্যাকসিন আনতে গিয়ে বিমানের কয়েকটি উড়োজাহাজের কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
যদিও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, একটি ভ্যাকসিনও বিমানের যাত্রী ক্যাবিনে আনা হয়নি। প্রতিটি ভ্যাকসিনের ব্যাগেজ এসেছে বিমানের কার্গো হোলে। কাজেই যাত্রী ক্যাবিন ভ্যাকসিনের কারণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে বিমান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যে তথ্য দিয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
Leave a Reply