চার দশক পেরিয়ে ৪১ বছরে পদার্পণ করেছে আরব বাংলাদেশ (এবি) ব্যাংক। ১৯৮১ সালের ৩১ ডিসেম্বর দেশের প্রথম বেসরকারি ব্যাংক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে এটি। পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮২ সালের ১২ এপ্রিল। সে হিসাবে আজ (১২ এপ্রিল) মঙ্গলবার এবি ব্যাংকের ৪০তম জন্মদিন বা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। দীর্ঘ এই পথ চলা সহজ ছিল না। আলোর পাশাপাশি ছিল অন্ধকারও।
সর্বশেষ যার ব্যবস্থাপনায় ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে তিনি হলেন এবি ব্যাংকের বর্তমান প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজিং ডিরেক্টর তারিক আফজাল। ভীষণ সাহসিকতার সঙ্গে লড়ে যাচ্ছেন ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে। এখন পর্যন্ত মন্দ ঋণ আদায়ে ৪৫ থেকে ৫০টি পুলিশি অভিযান পরিচালনা করেছেন। এতে গত দুই বছরে ঋণখেলাপি থেকে নগদ আদায় করেছেন প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য জানান তিনি। এ সময় নিজ ব্যাংকের সাফল্য এবং অগ্রগতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরার পাশাপাশি পুরো ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নানা সমস্যা এবং সম্ভাবনা নিয়েও কথা বলেন। তার আহ্বান-চিহ্নিত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। সর্বত্র সুশাসন প্রতিষ্ঠা করুন। তাহলেই ঘুরে দাঁড়াবে ব্যাংক খাত।
প্রশ্ন : এবি ব্যাংকের সার্বিক আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে বলুন।
তারিক আফজাল : এবি ব্যাংকের ২০১৮ সালে ঋণের অঙ্ক ছিল ২২ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। তিন বছরের ব্যবধানে অর্থাৎ ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটির ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এই সময়ে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০ শতাংশ। এছাড়া ২০১৮ সালে আমানতের অঙ্ক ছিল ২৪ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। তিন বছরের ব্যবধানে অর্থাৎ ২০২১ সালে আমানতের অঙ্ক ৩১ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। আমানত প্রবৃদ্ধি ২৭%।
প্রশ্ন : করোনায় এবি ব্যাংকের ভূমিকা কেমন ছিল?
তারিক আফজাল : করোনার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা তহবিল দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। প্রণোদনা তহবিলের ঋণ লক্ষ্যমাত্রার প্রায় শতভাগই বিতরণ করেছে এবি ব্যাংক।
প্রশ্ন : তিন বছরের ব্যবধানে এডি রেশিও ১০০% থেকে ৮৬.২৬% কীভাবে সম্ভব?
তারিক আফজাল : ডিপোজিট বেড়ে যাওয়ায় এডিআর কমে এসেছে। গত তিন বছরে এবি ব্যাংকের ইমেজের যে পরিবর্তন, বিশেষ করে নতুন বোর্ড, নতুন ম্যানেজমেন্টের নেতৃত্বের ওপর গ্রাহকের আস্থা বেড়েছে। এসব কারণে রিটেইল ডিপোজিট বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক নতুন প্রোডাক্টও বাজারে এনেছি। সবকিছুর সমন্বয়ে আমানত স্থিতি ২০১৮ সালের পর থেকে প্রতিবছরই ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। এটিই উন্নতির মূল কারণ। এছাড়া ব্যাংকের মানসিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে।
প্রশ্ন : কোন ধরনের গ্রাহককে ঋণ বিতরণে এবি ব্যাংক গুরুত্ব দিচ্ছে?
তারিক আফজাল : আগে শুধু করপোরেট লোন দেওয়া হতো, সে ধারাবাহিকতা থেকে সরে এসেছি। বর্তমানে সিএমএসএমই ঋণ বিতরণ বাড়িয়েছি। এছাড়া ভোক্তা ও কৃষি ঋণের ওপর জোর দিচ্ছি।
প্রশ্ন : ঋণ ও আমানত বৃদ্ধিতে এবি ব্যাংক কতটা সফল?
তারিক আফজাল : ২০১৮ সালে এবি ব্যাংকের মন্দঋণ ৩৩ শতাংশের বেশি ছিল, সে হার কমিয়ে ১৩.৮৮ শতাংশে নিয়ে এসেছি। ২০২১ সালে নিট মুনাফাও ২০১৯ সালের তুলনায় দ্বিগুণ করেছি। এই উন্নয়নের যে ধারাবাহিকতা সেটিকে বজায় রাখতে পেরেছি বলেই আমানত, শেয়ার প্রাইজ বা আর্নিং পার শেয়ার ভালো অবস্থানে আছে। পরিচালন মুনাফাও বেড়েছে। এসব সফলতা এককভাবে আসেনি। সমন্বিত প্রয়াসের ভিত্তিতে এসেছে। গ্রাহকদের আস্থাও এতে ভূমিকা রেখেছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে এবি ব্যাংকের অবস্থান খুবই শক্ত। বহু ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে মামলা করেছি, অনেক মামলায় কোর্ট থেকে ডিক্রি পেয়েছি। এগুলো প্রতিষ্ঠানের অর্থ আদায়ে সাহায্য করেছে, আয় বাড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বোর্ডের অনুমতি নিয়ে গত দুই বছর শেয়ার বাজারের গ্রাহকদের লভ্যাংশ দিয়েছি। কর্মপন্থা, স্টাফদের সিনসিয়ারিটি সবকিছু মিলিয়েই এই উন্নতি হয়েছে। পেছনে তাকালে মনে হয় অনেক পথ এগিয়েছি। আবার সামনে তাকালে দেখা যায় এখনো অনেক পথ বাকি। সবার সমন্বিত চেষ্টায় বাকি পথও পাড়ি দিতে চাই।
প্রশ্ন : কোন গুণ বা প্রোডাক্টের জন্য গ্রাহকরা এবি ব্যাংককে বেছে নেবে?
তারিক আফজাল : এবি ব্যাংকের গ্রাহক সেবা অন্যদের চাইতে আলাদা। ১৬২০৭ নম্বরের কল সেন্টার থেকে শুরু করে এজেন্ট ব্যাংকিং ও শাখা লোকেশনগুলোতে বা প্রধান কার্যালয়ে কোনো গ্রাহক সেবা নিতে এলে আমরা তাদের সর্বোত্তম সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। অনেক সময় কার্যপ্রণালির বাইরে গিয়েও তাদের সহায়তা করার চেষ্টা করি। এটাই আমাদের গ্রাহক আকর্ষণের মূল শক্তি ও মন্ত্র। এই মন্ত্রের আওতায় পরিচালিত হই বলেই ২০১৭-১৮ সালে যে পরিস্থিতি ছিল, সেটি সামাল দিয়ে আজকের এই উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় ফেরত আসতে পেরেছি।
প্রশ্ন : এবি ব্যাংকের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য কী?
তারিক আফজাল : দেশের প্রতিটি অঞ্চলে সব মানুষের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়াই এবি ব্যাংকের আগামী দিনের লক্ষ্য।
প্রশ্ন : ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ‘ব্লাড ক্যানসার’ খেলাপি ঋণের বিষয়ে কিছু বলুন?
তারিক আফজাল : ব্যাংকিং খাত থেকে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রসার ঘটাতে হবে। এগুলোর সঙ্গে প্রশাসনের সহায়তা এবং আইনের সঠিক ও কঠোর প্রয়োগেরও দরকার আছে। এসব পদক্ষেপ নেওয়া হলে খেলাপি ঋণ কমে যাবে। সবাই জানি কারা কারা ঋণখেলাপি। বাংলাদেশে কিছু চিহ্নিত ঋণখেলাপি আছে। এই ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে একটা প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ব্যাপক প্রসার বাংলাদেশ থেকে ইচ্ছাকৃত ও বৃহৎ খেলাপি ঋণের মাত্রা কমিয়ে আনবে। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কৃষি শিল্পের প্রসার ঘটানো সম্ভব হলে খেলাপির এই ঝুঁকি ডিস্ট্রিবিউট করতে পারব। তখন ঝুঁকির মাত্রা কম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খেলাপির পরিমাণ কমে আসবে। যারা চিহ্নিত ঋণখেলাপি আছেন তাদেরকে শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরি।
প্রশ্ন : নতুন বেতন-ভাতা বাস্তবায়নে এবি ব্যাংকের অবস্থান বলুন?
তারিক আফজাল : কর্মীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির ফলে আমাদের জিডিপি বাড়বে। স্পিনিং সক্ষমতা বাড়বে, মানি ফ্লো ভালো হবে। ব্যাংকে যে একটা পদের থেকে আরেকটি পদের অসামঞ্জস্যতা তা দূর করবে। এরকম অসামঞ্জস্যতা ব্যাংকারদের মধ্যে হতাশা তৈরি করে। এবি ব্যাংক এপ্রিল থেকেই নতুন কাঠামো অনুযায়ী বেতন-ভাতা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকেও জানানো হয়েছে।
Leave a Reply